কাঁচা পেঁপে খাওয়ার উপকারিতা পুষ্টিগুণ ও সাবধানতা
ভূমিকা০১
কাঁচা পেঁপে, সহজলভ্য এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি সবজি-ফল। এতে রয়েছে হজম‑শক্তি
বাড়াতে সহায়ক প্যাপেইন এনজাইম, প্রচুর ফাইবার, ভিটামিন A, C ও E, যা ইমিউনিটি
দৃঢ় করে, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং ত্বক-চুল উভয়ই উজ্জ্বলতায় ভরিয়ে তোলে
।
তবে, গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে বা ল্যাটেক্স‑অ্যালার্জি থাকা ব্যক্তিদের জন্য এটি
সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়, কারণ এতে বিরল ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাবও থাকতে
পারে।
সূচিপত্র
কাঁচা পেঁপের পুষ্টিগুণ০২
পেঁপে ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের ভান্ডার। এন পুষ্টিগুণ নিম্নরূপ
কম ক্যালোরি ও উচ্চ ফাইবারযুক্ত
১০০ গ্রাম কাঁচা পেঁপেতে মাত্র ৩২ ক্যালোরি ও ৭.২ গ্রাম শর্করা থাকে, যা ওজন
নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।কাঁচা পেঁপে একেবারে কম ক্যালোরিতে ভরপুর । প্রতি
১০০ গ্রামে মাত্র ৪৩ ক্যালোরি। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রায় ১.৭ গ্রাম খাদ্যতন্তু
(ফাইবার), যা প্রায় দেহের দৈনন্দিন ফাইবার চাহিদার ৭ % পূরণ করে ।
এই কম ক্যালোরি ও উচ্চ ফাইবারের সমন্বয় শরীরে দ্রুত পুষ্টি যোগায় কিন্তু দীর্ঘ
সময় পেটে ভরা অনুভূতি তৈরি করে যা অতিরিক্ত খাওয়া কমাতে এবং ওজন
নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া পেঁপেতে থাকা প্যাপেইন হজম
প্রক্রিয়াকেও সহায়তা করে যা পুরো পাচনব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করে তোলে।
ভিটামিন ও খনিজে সমৃদ্ধ
কাঁচা পেঁপে ১০০ গ্রামে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকে
ভিটামিন সি
প্রায় ৬০–৬২ মিঃগ্রাম, যা দৈনিক প্রয়োজনের প্রায় ৬০–৬৭ % পূরণ করে।
ভিটামিন এ (প্রোভিটামিন A / β‑Carotene)
৪৭ µg, অথবা ২৭৪ µg β‑carotene
বি‑কমপ্লেক্স ভিটামিন
- থায়ামিন (B1) ০.২৩ mg
- রাইবোফ্ল্যাভিন (B2) ০.০২৭ mg
- নিয়াসিন (B3) ০.৩৬ mg
- প্যান্তোথেনিক অ্যাসিড (B5) ০.১৯ mg
- পিরিডক্সিন (B6) ০.০৩৮ mg
- ফোলেট (B9) ৩৮ µg ।
- ভিটামিন E ০.৩ mg; ভিটামিন K: ২.৬µg
- পটাসিয়াম ১৮০–১৮২ mg
- ম্যাগনেশিয়াম ২১ mg
- ক্যালসিয়াম: ২০ mg
- ইরন: ০.২৫mg
- এছাড়াও: ফসফরাস ১০ mg, জিঙ্ক ০.০৮ mg, কপার ০.০৪৫ mg, সোডিয়াম ৮ mg, ম্যাঙ্গানিজ ০.০৪ mg
উপকারিতা
হজম ও পাচন প্রক্রিয়া উন্নত করে
কাঁচা পেঁপেতে আছে শক্তিশালী প্যাপেইন নামক প্রোটিন-ব্রেকডাউন এনজাইম যা
প্রোটিনগুলোকে সহজে হজমযোগ্য অ্যামিনো অ্যাসিডে পরিণত করে, ফলে বদহজম, গ্যাস
ও পেট ফুলে যাওয়ার সমস্যা কমে যায় ।
এছাড়া রয়েছে উচ্চ মাত্রায় ফাইবার, যা কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে মলকে নরম ও ভারী
করে তোলে। এছাড়াও প্রাচুর্যতা ভরপুর জলবস্তু (প্রায় ৮৮%), পাচন প্রক্রিয়ায়
আদ্রতা যোগায় ও মল সুষমভাবে পরিচালিত হতে সহায়তা করে । এক কথায়, পেঁপে একটি
প্রাকৃতিক পাচন সহায়ক, যা হজমকে সুগম ও স্বাস্থ্যকর করে তোলে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
কাঁচা বা পাকা পেঁপে ওজন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর, কারণ এটি কম ক্যালোরি (প্রতি
১০০ গ্রামে ৪৩ ক্যালরি) এবং উচ্চ ফাইবার এই দুইটোর মিলন যা কম খেয়ে দীর্ঘ
সময় পেট ভরা অনুভব করায় । এছাড়া এতে থাকে প্যাপেইন ও কাইমোপাপেইনের মতো
হজমোন্মুখ এনজাইম, যা প্রোটিন ও ফ্যাট ভাঙতে সহায়তা করে ফলে বিপাক দ্রুত ও
কার্যকর হয় ।
এর পাশাপাশি পেঁপেতে প্রচুর জল রয়েছে যা ডিটক্স এবং ফ্যাট ঝলাই প্রক্রিয়াকে
উৎসাহিত করে। সামগ্রিকভাবে, পেঁপে একটি লঘুক্যালোরি, পুষ্টি-সমৃদ্ধ এবং
হজমব্যবস্থা সহায়ক খাদ্য হিসেবে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণের ডায়েটে যুক্ত হতে
পারে।
হজম ক্ষমতা ও আন্টি‑ইনফ্ল্যামেটরি গুণ
পেঁপেতে থাকা শক্তিশালী প্যাপেইন ও কাইমোপ্যাপেইন এনজাইমগুলো প্রোটিনকে ছোট
অ্যামিনো অ্যাসিডে ভেঙে হজমকে সহজ ও দ্রুত করে তোলে ফলে বদহজম, গ্যাস্ট্রিক
ও কোষ্ঠকাঠিন্য অনেকাংশে সেরে ওঠে । পাশাপাশি, ফাইবার-সমৃদ্ধ এটি কাল্পনিক
ব্যাকটেরিয়া মলকে মসৃণভাবে বের করে দেয়, যা পেটে চাপ কমায়।
পাশাপাশি, পেপে-তে থাকা flavonoids, β‑carotene ও quercetin জাতীয়
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানগুলো শরীরের প্রদাহজনিত রাসায়নিক প্রক্রিয়া (যেমন
TNF‑α ও IL‑6) হ্রাস করে। এছাড়া আর্থ্রাইটিস, পাতলা ফুসফুস বা
গ্যাস্ট্রাইটিসের মতো প্রদাহজনিত সমস্যা কমাতে সহায়তা করে । এক কথায়, পেঁপে
হজম ও প্রদাহ দুটি প্রক্রিয়াই সুগম ও স্বস্তিদায়ক করে তোলে।
রোগ প্রতিরোধ ও রোগজীবাণুবিরোধী গুণ
পেঁপে একটি চমৎকার রোগপ্রতিরোধী ও জীবাণুবিরোধী খাদ্য। এটি ভিটামিন C, A এবং
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ যা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে শরীরকে সংক্রমণ
থেকে রক্ষা করে । বিশেষ গবেষণায় দেখা যায় যে, পেঁপে বীজে থাকা কার্পেইন
অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিপ্যারাসিটিক গুণসম্পন্ন যা, কিছু ব্যাকটেরিয়া
ও পরজীবী দূর করতে সহায়তা করে।
এছাড়া, পেঁপে পাতার এক্সট্র্যাক্টে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড, ফেনল, এনজাইম এবং
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানগুলো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা
প্রদান করে, বিপাকজনিত ক্ষতি কমায়, প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ও রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা উন্নত করে।
রক্তচাপ ও হাইপোগ্লাইসেমিয়া
পেঁপেতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ
পটাসিয়াম, যা সোডিয়ামের
বিরোধী হিসেবে কাজ করে এবং রক্তচাপ কমাতে সহায়ক। এছাড়া এতে থাকা
ভিটামিন C, A, ও
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন
লাইকোপিন, β‑Carotene
রক্তনালীর অস্থিরতা ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে হার্টের চাপ হ্রাস করে ।
ফাইবার হৃদযন্ত্রে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে রক্তব্যবস্থাকে
স্বাচ্ছন্দপূর্ণ রাখে। সামগ্রিকভাবে, নিয়মিত পেঁপে খাওয়া হৃদরোগ ও উচ্চ
রক্তচাপের ঝুঁকি হ্রাসে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।কাজেই যারা অধিক ইনসুলিন ও
ডায়াবেটিসের মেডিসিন সেবনের কারণে হাইপোগ্লাইসেমিয়া জনিত সমস্যায় ভুগছেন
তারাও পেঁপে খেতে পারেন।
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
কাঁচা পেঁপে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, কারণ এতে রয়েছে
উচ্চ ফাইবার ও কম গ্লাইসেমিক লোড, যা রক্তে চিনির শোষণ ধীর করে
স্পাইক কমায় এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স প্রায় ৬০ এবং গ্লাইসেমিক লোড মাত্র ৫.৫
থাকে যা নিরাপদ ।
অপরদিকে, এর প্যাপেইন ও কাইমোপ্যাপেইন এনজাইম শর্করা ও প্রোটিন হজমে
সহায়ক, ফলে রক্তে গ্লুকোজ দ্রুত না ছড়িয়ে ধীরে ছড়ায় । তাছাড়া এতে থাকা
ভিটামিন C, বেটা‑কারোটিন
ও ফ্ল্যাভনয়েড জাতীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়
এবং রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চুল ও ত্বকের যত্নে
পেঁপে ত্বক ও চুলের জন্য এক প্রাকৃতিক উপকারী খাদ্য। এতে থাকা প্যাপেইন নামক
এনজাইম মৃত ত্বক ও দাগ ঝেড়ে সরিয়ে দেয়, ফলে ত্বক উজ্জ্বল ও মসৃণ হয়; একইসঙ্গে
প্রাকৃতিক এক্সফোলিয়েন্ট হিসেবে কাজ করে ও মসৃণতা বৃদ্ধি করে ।
ভিটামিন A ও C কলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায় এবং
সূক্ষ্ম রেখা ও বলিরেখা কমায় । চুলের ক্ষেত্রে, ভিটামিন A-র উপস্থিতি
স্ক্যাল্পকে সেরাম তৈরিতে উৎসাহিত করে, যা চুলকে পুষ্টি দেয় ও শক্তিশালী করে;
এর পাশাপাশি অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণ ড্যান্ড্রাফ নিয়ন্ত্রণ ও চুলে প্রাকৃতিক
উজ্জ্বলতা আনে ।
শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষায়
কাঁচা পেঁপে (উরিপন পেঁপে) বাচ্চাদের জন্য অত্যন্ত পুষ্টিকর। এতে উপস্থিত
প্যাপেইন এনজাইম হজমে সহায়তা করে এবং উচ্চ ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে
কার্যকর যা একটি স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর পাচনব্যবস্থা নিশ্চিত করে । এছাড়া,
ভিটামিন C‑এ সমৃদ্ধ এই ফল ইমিউনিটি শক্তিশালী করে যেহেতু শিশুরা সংক্রমণে
সহজে আক্রান্ত হয়।
ভিটামিন A ও β‑ক্যারোটিন চোখের ও ত্বকের যত্নে কাজে লাগে । ফোলেট, পটাসিয়াম ও
অন্যান্য খনিজ উপাদানের কারণে এটি হাড়, রক্ত এবং সার্বিক শারীরিক বিকাশে সহায়ক। এভাবেই কাঁচা পেঁপে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও সুস্থতায় ভূমিকা রাখে।
অন্যান্য উপকারিতা
মাসিক ব্যথা কমায়, মানসিক চাপ হ্রাসে (স্ট্রেস কমানো), ফুসফুসের স্বাস্থ্য
ভালো রাখা, অ্যান্টি‑ক্যান্সার গুণ সবই কাঁচা পেঁপে তে আছে।
অপকারিতা ও সতর্কতা
গর্ভবতী মহিলাদের ঝুঁকি
প্যাপেইন ও ল্যাটেক্স জরায়ুকে সংকুচিত করতে পারে, গর্ভপাতের আশঙ্কা বৃদ্ধি
করে। উক্ত কারণে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই গর্ভবস্থায় এড়িয়ে চলাই উত্তম।
অ্যালার্জি ও শ্বাসকষ্ট
ল্যাটেক্স‑অ্যালার্জি ও প্যাপেইন‑সংবেদনশীল ব্যক্তিরা পেঁপে খেলে চুলকানি,
ফুসকুড়ি, শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
হজম সংক্রান্ত সমস্যা
অতিরিক্ত ফাইবার ও এনজাইমের কারণে পেট ফোলা, গ্যাস, ডায়রিয়া বা পেট ব্যথা
হতে পারে।
প্রজনন ক্ষমতা
কাঁচা পেঁপের বীজ বা নির্যাস পুরুষের শুক্রাণু গুনমান হ্রাস করতে পারে,
প্রজননক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
রক্তচাপ ও হাইপোগ্লাইসেমিয়া
রক্তচাপ কমায়, তাই হাই বা লো রক্তচাপের ওষুধ সেবনকারীরা সতর্ক হোন
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।
কিডনি ও ক্যালসিয়াম সমস্যা
অতিরিক্ত ভিটামিন সি কিডনিতে পাথর তৈরি করতে পারে; অতিরিক্ত পটাসিয়ামও সমস্যা
বাড়ায়।
অতিরিক্ত খাওয়ার নির্ধারিত সীমা
দিনে এক কাপের বেশি কাঁচা পেঁপে না খাওয়াই ভালো অতিরিক্ত হলে খাদ্যনালীতে
ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে ।
কীভাবে সুরক্ষিতভাবে খাওয়া উচিত?
পরিমিত পরিমাণে যেমন দিনে এক কাপ (প্রায় ১৫০ গ্রাম) পর্যাপ্ত এবং
নিরাপদ। গর্ভবতী মহিলা ,অন্য কোন কঠিন রোগ বা এলার্জি থাকলে প্রথমে ডাক্তারের
পরামর্শ নিন।
উপসংহার০৫
কাঁচা পেঁপে একদিকে পুষ্টিতে ভরপুর, হজম ও ইমিউনিটি বাড়ায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে
সহায়তা করে, ত্বক-তন্দ্রা ও মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারি। অন্যদিকে,
গর্ভবতী, অ্যালার্জি, প্রজনন সমস্যা, কিডনি বা রক্তচাপজনিত শর্তে পেঁপের ক্ষেত্রে সতর্কতার
প্রয়োজন। সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এবং নিজের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এটি
ডায়েটে যুক্ত করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
স্মার্ট ইনফো ডেস্কের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্টের রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url